সোনারচরঃ
বাংলাদেশে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পরে আর একটি সৈকতের নাম জানতে চাইলে সবাই এক বাক্যে বলবে পটুয়াখালীর কুয়াকাটা। কিন্তু দেশের বেশীর ভাগ লোকই জানেন না যে এই জেলাতেই রয়েছে আমাদের দেশের আর একটি দৃষ্টিনন্দন ও নয়ানাভিরাম সমুদ্র সৈকত। নাম সোনারচর(Sonarchar) সমুদ্র সৈকত।
পটুয়াখালী জেলা সদর থেকে প্রায় দেড় শ’ কিলোমিটার এবং গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে সাগরের মাঝ বরাবরে এর অবস্থান। গত কয়েক বছরে পর্যটকদের কাছে সোনার চর বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিপদসঙ্কুল দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা উপেক্ষা করে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করতে অনেকেই যাচ্ছে সোনার চরে। সাগরের উত্তাল ঢেউ। জেলেদের মাছ ধরা। বিশাল বনাঞ্চল ছাড়াও সেখানে দেখার আছে অনেক কিছু। বিশেষ করে প্রায় দশ কিলোমিটার লম্বা বিশাল সমুদ্র সৈকত জুড়ে কোটি কোটি লাল কাঁকড়ার বিচরণ পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। দেখে মনে হবে যেন লাল কাঁকড়ার ভিন্ন এক জগত। গোটা সৈকত লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছে।
পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলা সদর থেকে সড়কপথে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণে পানপট্টি লঞ্চঘাট। সেখান থেকে সামনে এগিয়ে গেলেই আগুনমুখা মোহনা। ট্রলার কিংবা লঞ্চযোগে আগুনমুখা মোহনা থেকে ঘণ্টা তিনেক এগুলেই চোখে পড়বে মায়াবী দ্বীপচর তাপসী। তাপসীর বাঁকে পৌঁছাতেই সোনারচরের হাতছানি। তাপসী থেকে ৩০ মিনিটের পথ সামনে এগুলেই সোনারচর। প্রায় ১০ কিমি দীর্ঘ একটি অনন্য সুন্দর চোখ জুড়ানো সমুদ্রসৈকত।
বাইরে থেকে আসা বেশিরভাগ পর্যটকই পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় ঘুরে চলে যান। কিন্তু সোনারচর, রূপারচর ও চরহেয়ারসহ সমুদ্র ফুলে জেগে ওঠা সবুজ বনাঞ্চলের সন্ধান জানেন না অনেকেই। সাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যের দ্বীপ সোনারচর। এ দ্বীপের একই জায়গায় দাঁড়িয়ে অবলোকন করা যায় সূর্যের উদয়াঅস্ত। এর চারদিকেই দিগন্ত-বিস্তৃত সাগরের অথৈ নীল জলরাশি। উথালপাতাল ঢেউ দীর্ঘ সমুদ্র সৈকতে জোয়ারের সময় আছড়ে পড়ে দৃষ্টিনন্দনভাবে। ভোরের সূর্য কোমল আলো ছড়ায় সোনারচরের চিক চিক বালুকণায়। অস্তগামী সূর্যের লালিমা তেমনি মায়া ঢালে নিভৃতের আঁধারে। অপরূপ সৌন্দর্যের আধার সোনারচর বর্ণিল শোভায় ঘেরা। দূর থেকে মনে হয় কোনো শিল্পীর হাতে আঁকা নিপুণ ছবি। প্রকৃতি যেন অকৃপণ হাতে উজাড় করে সৃষ্টি করেছেন এ দ্বীপটিকে।
নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের এক আধার এই সোনারচর সমুদ্র সৈকত। শেষ বিকালের রোদের আলো যখন সোনারচরের বেলেভূমিতে পড়ে, তখন পুরো দ্বীপটাকেই মনে হবে যেন কাঁচা সোনার প্রলেপ দেয়া একটি সোনালি থালা। সাগরে যখন জোয়ারের পানি উথলে ওঠে, তখন অন্য এক সৌন্দর্য বিকশিত হয় সোনারচরে। তটরেখায় আছড়ে পড়ে ছোট-বড় ঢেউ। গলে পড়ে ঝুরঝুরে বালি। লোনাপানিতে ঘন সবুজ অরণ্যের নিবিড় ছাউনি।
সোনারচরে সোনা নেই ঠিকই কিন্তু আছে সোনার অঙ্গের বালি। সূর্যের প্রখর রোদ যখন বালির উপর পরে দূর থেকে তা দেখতে সোনার মতই। এভাবে ৩০ এর দশকে জেগে ওঠা অপার সম্ভাবনা সৌন্দর্যের দ্বীপটির নাম পাল্টে গিয়ে হয় সোনারচর।
ম্যানগ্রোভ ফরেষ্ট
এখানে দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত ছাড়াও আছে ৫ হাজার একরের বিশাল বনভূমি। গলাচিপা উপজেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্যমতে, সুন্দরবনের পরই আয়তনের দিক থেকে এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বনাঞ্চল। সোনারচরের বিশাল বনভূমির মধ্যে ছড়িয়ে আছে দেড় শতাধিক ছোট-বড় খাল। ছোট্ট নৌকা বা ইঞ্জিনচালিত ট্রলার নিয়ে এসব খালে ভেসে ভেসে দেখা যায় বিচিত্র সব পাখ-পাখালির বিচরণ। তবে ভয় নেই। একমাত্র শিয়াল আর মেছোবাঘ ছাড়া হিংস্র কোনো জন্তু নেই এখানে।
বনাঞ্চলের কাছাকাছি গেলে হয়তো সহজেই চোখে পড়বে বুনো মোষ। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা হতে পারে হরিণ পালের সঙ্গে। এখানে রয়েছে শূকর, বানর, মেছোবাঘসহ অন্যসব বন্যপ্রাণী। এসব দেখতে হলে খুব সকালেই বেরিয়ে পড়তে হবে। দেখতে পারবেন সমুদ্রগামী হাজারো জেলের জীবনসংগ্রাম। পর্যটকদের জন্য এখানে রয়েছে একটি ডাকবাংলো এবং বন বিভাগের ক্যাম্প।
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত
এখানে আছে প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত। এখন আর কুয়াকাটাই একমাত্র সমুদ্র সৈকত নয় যেখানে একই স্থান হতে সূযোর্দয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। সোনারচর সমুদ্র সৈকতও এইক রূপে অপরূপা। এখানেও একই জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখা যায় সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের এক অপুলক দৃশ্য।
লাল কাঁকড়ার গালিচা
সোনারচরের আর একটি আকর্ষনীয় দিক হল সৈকত পাড়ের লাল কাঁকড়া। প্রায় দশ কিলোমিটার লম্বা বিশাল সমুদ্র সৈকত জুড়ে কোটি কোটি লাল কাঁকড়ার বিচরণ। দেখে মনে হবে যেন এ এক লাল কাঁকড়ার বিশাল রাজ্য। গোটা সৈকত লাল গালিচা বিছিয়ে রেখেছে। কাঁকড়ার এ প্রজাতিটি সামুদ্রিক প্রাণী হলেও চরের বালুমাটিতেই বাস করে। বালুমাটির গভীরে তৈরি সুড়ঙ্গে দলবেঁধে চলাচল করে। সমুদ্রের জোয়ারের পানিতে গোটা সৈকত যখন ডুবে যায়, তখন ওরা নিরাপদ আশ্রয় নেয় সেই সুড়ঙ্গে। লাল কাঁকড়ার অবাধ চলাচল যতই চোখ জুড়াক না কেন ওদের ধরা কিন্তু ততটা সহজ নয়। মানুষের শব্দ পেলেই ওরা নিজেদের তৈরি সুড়ঙ্গের ভেতর লুকিয়ে যায়। যে কারণে কম করে হলেও ১০/২০ ফুট দূর থেকেই লাল কাঁকড়ার সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয়। সমুদ্রের কাঁকড়া বেশ সুস্বাদু হলেও এ প্রজাতিটি যথেষ্ট বিষাক্ত। যে কারণে এটিকে কেউ ধরে না বা নিধন করে না। ওরা গর্ত বা সুড়ঙ্গ করার সময়ে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করেও এক অপূর্ব শিল্পকর্ম সৃষ্টি করে। যা দেখে মনে হবে যেন কোন শিল্পী তার নিপুণ হাতে মাটিতে অাঁচড় দিয়েছে। পর্যটকদের কাছে সোনারচরের লাল কাঁকড়ার এ রাজত্ব আরেকটি দর্শণীয় বিষয়। একবার ঘুরে এলেই এর প্রমাণ মিলবে।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস